মহানবী (সা.)-এর যুগে ইসলামী শিক্ষা যেমন ছিল

নবী-রাসুল (আ.) ছিলেন মানবজাতির শিক্ষক। সর্বোত্তম শিক্ষক ছিলেন মহানবী (সা.)। তিনি নবুয়তের পবিত্র দায়িত্ব লাভের পর থেকেই শুরু হয়েছিল তার শিক্ষা মিশন। কোনো প্রতিকূলতাই তাকে দায়িত্ববিমুখ করতে পারেনি। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। ’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ২৫৭) শিক্ষার মর্যাদা : পবিত্র কোরআনের প্রথম বার্তা ছিল, ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’ (পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন)। পবিত্র কোরআনে একাধিক আয়াতে আল্লাহ মানবজাতিকে শিক্ষাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যা নববী যুগে শিক্ষার মর্যাদা প্রমাণ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান?’ (সুরা ঝুমার, আয়াত : ৯) অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের মর্যাদায় উন্নত করবেন; তোমরা যা কোরো আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত। ’ (সুরা মুজাদালা, আয়াত : ১১) জ্ঞানার্জনে উৎসাহ দান : ইসলাম শুধু জ্ঞান ও জ্ঞানীর মর্যাদাই ঘোষণা করেনি; বরং জ্ঞানার্জনে উৎসাহ দিয়েছে এবং জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়াকে ‘আল্লাহর রাস্তা’ আখ্যা দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করতে বের হয়, আল্লাহর রাস্তায় বলে গণ্য হবে যতক্ষণ না সে ঘরে ফেরে। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৬৪৭)। তিনি আরো বলেন, ‘জ্ঞানার্জন মানুষের অতীত পাপের মার্জনাস্বরূপ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৬৪৮) জ্ঞানের প্রার্থনা : ইসলামী সমাজব্যবস্থায় জ্ঞান মর্যাদা ও সম্মানের বিষয়। তাই মুসলমানের কাছে জ্ঞান প্রার্থিত বিষয়ও। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, হে আমার প্রতিপালক, আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন। ’ (সুরা তোহা, আয়াত : ১১৪) জ্ঞানার্জন বাধ্যতামূলক : নববী যুগে ইসলামী জ্ঞানার্জন করা বাধ্যতামূলক ছিল। রাসুসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর জ্ঞানার্জন করা ফরজ। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪) জ্ঞান বিতরণ বাধ্যতামূলক : নববী যুগে জ্ঞানীদের জন্য জ্ঞান বিতরণ করা ছিল বাধ্যতামূলক। কেউ কোনো জ্ঞান লাভের পর তা গোপন করতেন না। কেননা নবী করিম (সা.)-এর নির্দেশ ছিল, ‘যে ব্যক্তিকে কোনো জ্ঞান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলো এবং সে তা গোপন করল, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন আগুনের লাগাম পরিধান করাবেন। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৬৫৮) মূর্খতা অগ্রহণযোগ্য : নববী যুগে মূর্খতা ছিল অগ্রহণযোগ্য। তখন কোনো ব্যক্তি মূর্খতার মধ্যে জীবনযাপন করতে পারত না। নবীজি (সা.) বলেন, ‘কোনো জ্ঞানীর উচিত না, তার জ্ঞান নিয়ে চুপ থাকা (আড়াল করা) এবং কোনো মূর্খের উচিত নয় তার মূর্খতার ব্যাপারে চুপ থাকা (সন্তুষ্ট থাকা)। ’ (মুজামুল আউসাত, হাদিস : ৫৩৬৫) নববী যুগে মানুষ জ্ঞানার্জনে লজ্জা বোধ করতেন না। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আনসারি নারীরা কতই না উত্তম। দ্বিন সম্পর্কে মাসআলা জিজ্ঞাসা করতে এবং দ্বিনি জ্ঞানে ব্যুৎপত্তি অর্জনে তারা লজ্জাবোধ করে না। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩১৬) বয়স বাধা ছিল না : বেশির ভাগ সাহাবি পরিণত বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলাম গ্রহণের পর তারা দ্বিনি ইলম অর্জন করেন। এ জন্য ইমাম বুখারি (রহ.) বলেন, ‘তোমরা জ্ঞানার্জন কোরো নেতা হওয়ার আগে ও পরে। কেননা আল্লাহর রাসুলের সাহাবিরা বৃদ্ধ বয়সেও জ্ঞানার্জন করেছেন। ’ (সহিহ বুখারি, কিতাবুল ইলম বা জ্ঞান অধ্যায়) প্রতিকূলতার মধ্যেও থেমে ছিল না : ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কার মুসলিমরা প্রতিকূল সময় অতিক্রম করছিল। কিন্তু তখনো থেমে ছিল না ইসলামী শিক্ষার কার্যক্রম। তিনি আরকাম ইবনে আবিল আরকাম (রা.)-এর ঘরকে শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করেন। সেখানে সাহাবিরা গোপনে নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে মিলিত হতেন এবং শিক্ষা গ্রহণ করতেন। এ ছাড়া গোপনীয়তা রক্ষা করে মুসলিমরা পরস্পরকে শিক্ষা দান করত। যেমন ওমর (রা.)-এর বোন ও বোন-জামাইকে খাব্বাব ইবনুল আরাত (রা.) গোপনে কোরআন শিক্ষা দিতেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম) প্রথমে শিক্ষক প্রেরণ : নবীজি (সা.) মদিনায় হিজরত করার আগেই সেখানে একজন শিক্ষক প্রেরণ করেন। যিনি তাদের ঈমান ও ইসলামের পাঠদান করত। মহানবী (সা.) তাঁর প্রতিনিধি ও শিক্ষক হিসেবে মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.)-কে প্রেরণ করেন। তিনি তাদের কোরআন শেখাতেন, নামাজের ইমামতি করতেন এবং ইসলাম প্রচার করতেন। সে সময় তিনি ‘মুকরি’ (কোরআন পাঠকারী) উপাধিতে ভূষিত হন। মদিনায় গিয়ে তিনি আসআদ ইবনে জুরারা (রা.)-এর বাড়িতে অবস্থান করেন। মুসআব (রা.)-এর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে মদিনার প্রভাবশালী নেতা সাআদ বিন মুয়াজ ও উসাইদ বিন হুদাইর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। (খাতামুন নাবিয়্যিন, পৃষ্ঠা ৪৩৮; আর-রাসুল, পৃষ্ঠা ১০২) শিক্ষা সিলেবাস : নবীজি (সা.) ছিলেন দ্বিনের শিক্ষক। দ্বিন হিসেবে ইসলাম যেমন পূর্ণাঙ্গ, নবীজি (সা.)-এর শিক্ষা সিলেবাসও ছিল এমন পূর্ণাঙ্গ। মানবজীবনের প্রয়োজনীয় কোনো কিছুই তার শিক্ষা সিলেবাসের বাইরে ছিল না। এমনকি তিনি ইস্তেনজা করার শিষ্টাচারও শিক্ষা দেন। শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা : মদিনায় হিজরতের পর মদিনায় মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে ‘সুফফা’ নামক একটি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন মহানবী (সা.)। ‘সুফফা’-ই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সুফফা ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হুজরাগুলোর নিকটবর্তী স্থানে। সুফফার অধিবাসীরা সাধারণত সারা দিন সেখানেই থাকতেন। কোরআনের আয়াত, নবীজি (সা.)-এর বাণীগুলো (হাদিস) শুনতেন এবং তা আত্মস্থ করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের শরিয়তের বিধি-বিধান শেখাতেন। তিনি তাদের কখনো কখনো খাবারের জন্য নিজের ঘরে নিয়ে যেতেন। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ২/২৮)

Post a Comment

0 Comments